মো. শাহজাহান বাশার, সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার
যখন ঢাকার রাস্তায় রিকশা, বাস কিংবা মোটরগাড়ির কোনো অস্তিত্ব ছিল না, তখন বাঙালির আভিজাত্য, সম্মান ও ভালোবাসার প্রতীক ছিল একটিমাত্র বাহন — “পালকি”।
ঢাকার নবাবপুর, লালবাগ কিংবা চৌকবাজারের সরু গলিতে প্রতিদিন দেখা যেত পালকির চলাচল। পালকির দুলুনিতে বাজত রাজকীয় ছন্দ, যেখানে বসে থাকতেন নবাব পরিবারের বেগম, জমিদারবাড়ির কন্যা কিংবা নববধূ।
পালকি তখন শুধু যানবাহন ছিল না—এটি ছিল সম্মানের প্রতীক, সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি এবং নারীর পর্দার আড়ালে থেকেও সমাজে চলাফেরার একমাত্র উপায়।
বাংলায় পালকির প্রচলন শুরু হয় প্রায় ১৫শ শতকে। মুঘল আমলে ঢাকার অভিজাত নারীরা বাইরে যেতেন কেবল পালকিতে চড়ে।
রেশম-মখমলে মোড়ানো সেই পালকিতে চড়ে তারা যেতেন বাজারে, আত্মীয়ের বাড়িতে কিংবা ঈদের নামাজে।
সেই সময় পালকি হয়ে ওঠে নারীর গোপন স্বাধীনতার বাহন।রবীন্দ্রনাথও সেই দৃশ্য স্মরণ করে লিখেছিলেন —“দুল দুল দুল পালকি চলে, পালকিতে বউ চলে.
এই গান শুধু কাব্য নয়, বরং এক যুগের বাস্তব জীবনের প্রতিচ্ছবি।
ঢাকা যখন নবাবদের রাজত্বকেন্দ্র, তখন পালকি হয়ে ওঠে আভিজাত্য ও সামাজিক মর্যাদার প্রতীক।নবাবদের পালকি তৈরি হতো বিশেষ কারিগরদের হাতে— কখনো মখমলে মোড়ানো, কখনো রেশমে সেলাই করা কাঠের দেহে রূপালী নকশা।চারজন বলিষ্ঠ বাহক কাঁধে তুলে চলতে থাকত পালকি, আর পথজুড়ে বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকত মানুষ।
নবাব পরিবারের কন্যা বা বেগমের বাহিরে যাওয়া মানেই ছিল পালকির ঘণ্টাধ্বনি—
রাজকীয় ও সম্মানজনক এক দৃশ্য।
ব্রিটিশ শাসনামলেও পালকি টিকে ছিল বাংলার জীবনধারায়।যদিও তখন ঘোড়ার গাড়ি, ট্রলি, ও পরবর্তীতে রিকশার আগমন ঘটে, তবু পালকি হারায়নি তার মর্যাদা।অভিজাত পরিবার, জমিদারবাড়ি কিংবা বিয়ের শোভাযাত্রায় পালকি ছিল অপরিহার্য উপকরণ।
অনেক নববধূর প্রথম যাত্রা শুরু হতো এই পালকির দুলুনিতেই।একটা সময় গ্রামীণ বিয়েতে বলা হতো— “পালকি ছাড়া বিয়ে অসম্পূর্ণ।”
১৯৪৭ সালের পরও বাংলার গ্রামে নববধূকে পালকিতে করে নিয়ে যাওয়ার রীতি অটুট ছিল।চার-পাঁচজন পালকীবাহক গান গাইতে গাইতে কাঁধে তুলে নিতেন নববধূকে, আর পুরো গ্রাম মাতত আনন্দে।স্বাধীনতার পরও এ দৃশ্য দেখা যেত গ্রামীণ বাংলায়।তখনও অনেক পরিবার মনে করত, “পালকি ছাড়া বিয়ে মানে শোভাযাত্রার প্রাণহীনতা।”
কিন্তু সময়ের চাকা ঘুরতে ঘুরতে পালকি হারিয়ে যেতে শুরু করে—পাকা রাস্তা, মোটরযান, ভ্যান, রিকশা আসার পর পালকি হয়ে পড়ে অতীতের স্মৃতি।আজ পালকি কেবল ইতিহাসের প্রদর্শনী, বিয়ের সাজসজ্জা বা নাট্যচিত্রের প্রপস মাত্র।
যদিও আমরা পালকিকে বাংলার নিজস্ব ঐতিহ্য ভাবি, আসলে এর উৎপত্তি আরও প্রাচীন।ঐতিহাসিকদের মতে, প্রথম পালকির ধারণা জন্ম নেয় প্রাচীন চীন ও জাপানে।রাজা-রাজড়ারা দূরযাত্রায় বিশ্রামের জন্য তৈরি করেছিলেন মানুষবাহী একধরনের চেয়ার—যা পরে ভারতবর্ষে এসে রূপ নেয় “পালকি”-তে।
মুঘল আমলে এই পালকি জনপ্রিয়তা পায়, আর ব্রিটিশ শাসনামলে এশিয়ার বিভিন্ন প্রদেশে তা হয়ে ওঠে একটি সামাজিক মর্যাদার প্রতীক।
ঢাকায় তখন ঘোড়ার গাড়ির চেয়েও বেশি দেখা যেত পালকি।কাদামাখা গলি, নবাবপুর–লালবাগ–চৌকবাজারের সরু পথ —সবখানেই চলত সেই দুলে দুলে পালকি।
আজকের তরুণ প্রজন্ম হয়তো পালকি কখনো চোখে দেখেনি।তবুও পুরনো ছবিতে যখন দেখি একখানা পালকি,মনে হয় যেন শুনতে পাচ্ছি সেই পুরনো ঢাকার গলিতে কারো ডাক—“চল মেমসাহেব, পালকি রেডি আছে!”পালকি হারিয়ে গেছে, কিন্তু তার দুলুনির ছন্দ এখনো বেজে ওঠে
ইতিহাসের অন্তরালে,বাঙালির সংস্কৃতির নরম ছোঁয়ায়।